মানব সৃষ্টির রহস্য : পর্ব ১

মানব সৃষ্টির রহস্য নানা বিস্ময়কর ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। কোরান ও বিজ্ঞানের আলোকে মানব সৃষ্টির বিস্ময়কর ঘটনাগুলো পর্ব আকারে আলোচনা করা হলো। এই আর্টিকেলে মানুষ  সৃষ্টির বিস্ময়কর  রহস্যের  ১ম পর্ব নিয়ে আলোকপাত করা হলো ।

কোষ বিভাজন 

যে  চলচ্চিত্রটি আপনি দেখতে যাচ্ছেন, তা ব্যাখ্যা করছে কিভাবে মানব সৃষ্টি হয়েছে এবং অস্তিত্ব পাওয়ার জন্য তাকে কোন কোন ধাপের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এই  চলচ্চিত্রটি আপনার সম্পর্কেই। চলুন, সময়ের অভ্যন্তরে একটি সংক্ষিপ্ত সফর করি এবং অতীতে চলে যাই। প্রত্যক্ষ করি একটি অসাধারন কাহিনী, যা নানা বিস্ময়কর ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। দেখি মানুষ একসময় কি ছিল। মায়ের গর্ভে একটি একক কোষ। একটি অসহায় বস্তু যার নিরাপত্তার প্রয়োজন। একদানা লবনের চেয়েও ক্ষুদ্রতর। আপনিও একসময় এই  একক কোষ দিয়ে গঠিত হয়েছিলেন। বিশ্বের আর সকলের মতই। তারপর এই কোষটি ভেঙে দুটি কোষ তৈরি হল। তারপর আবার তারা বিভাজিত হয়ে চারটি কোষ হলো। তারপর আটটি, তারপর ষোলটি। কোষ বিভাজন চলতেই থাকলো। প্রথমে তৈরি হলো এক টুকরো মাংস। তারপর এই মাংসপিন্ডটি একটি আকৃতি নিল। এর বাহু, পা ও চোখ তৈরি হলো। আদি কোষের তুলনায় এটি বেড়ে  ১০০ বিলিয়ন গুণ বড় হলো এবং ৬ বিলিয়ন গুণ ভারি হলো। এভাবে আল্লাহ বিস্ময়ের পর বিস্ময়  সংঘটিত করলেন এবং তৈরি করলেন মানুষ। যা আপনি চলচিত্রে দেখছেন যে, মানুষ একসময়  ছিল এক ফোঁটা পানি মাত্র।

আল্লাহ কোরআনে জানিয়ে দিলেন, তিনি মানুষকে কিভাবে  সৃষ্টি করেছেনঃ  “মানুষ কি এই ধারনা করে যে, তাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উদ্দেশ্যবিহীন ছেড়ে দেয়া হবে ? সে কি স্থলিত তরল বীর্য ছিল না ?  অতঃপর সে ছিল রক্তপিন্ড, তারপর আল্লাহ তাকে সুবিন্যস্ত করে সৃষ্টি করেছেন  এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন নর ও নারী। তবুও কি আল্লাহ  মৃতদেরকে জীবিত করতে সক্ষম নন ?  (সুরা আল কিয়ামাহ, আয়াতঃ ৩৬,৩৭,৩৮,৩৯,৪০)

ডিম্বকোষের সফর

মানব সৃষ্টির রহস্য এর প্রথম আশ্চর্য ঘটনার শুরু হচ্ছে একজন স্ত্রীলোকের দেহে। ডিম্বাশয় নামক অঙ্গে, যেখানে একটি একক ডিম্বকোষ পরিপূর্ণতা লাভ করছে। এই ডিম্বকোষের সামনে রয়েছে লম্বা সফর। প্রথমেই এটি প্রবেশ করবে ডিম্বনালিতে। তারপর সেখানে লম্বা দুরুত্ব অতিক্রম করে অবশেষে পৌঁছাবে মায়ের গর্ভে। ডিম্বাশয় থেকে পরিপূর্ণ ডিম্বকোষ বের হওয়ার পূর্বেই “ডিম্বনালি” সেটিকে ধরার জন্য তৈরি হয়। সুক্ষ্ম নড়াচড়ার সাহায্যে এটি ডিম্বাশয়ের উপর থেকে ডিম্বকোষটির অবস্থান নির্ণয়ের চেস্টা করে। এভাবে ডিম্বনালি অনুসন্ধান করে  ডিম্বকোষটিকে খুজে বের করে এবং নিজের ভিতর টেনে নেয়। অবশেষে শুরু হয় ডিম্বকোষের সফর। সম্পূর্ণ ডিম্বনালিটি সে অতিক্রম করে কিন্তু এ কাজের জন্য তার কোন প্রত্যঙ্গ নেই, কোন পাখা অথবা পা। একটি বিশেষ পদ্বতির সৃষ্টি করা হয়েছে এ কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য।ডিম্বনালির ভিতরের লক্ষ লক্ষ কোষকে  বিদ্যুতায়িত করার ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে ডিম্বকোষটি নিশ্চিতভাবে গর্ভে প্রবেশ করতে পারে। এই কোষগুলো তাদের উপরের স্তরে সিলিয়া নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চুলগুলোকে এমনভাবে স্থাপন করে যেন তারা গর্ভের দিকে মুখ করে থাকে। এভাবে তারা ডিম্বাণুকে সঠিক পথের দিকে পাঠায়, যেন অতি মুল্যবান  একটি বস্তু একজনের হাত থেকে অপরজনের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের  জন্য ভেবে দেখুনতো এই ঘটনাটি। এই সিলিয়া নামক অতি ক্ষুদ্র  চুলগুলো  নিশ্চয়ই  একটি বুদ্ধিমান পরিকল্পনার অংশ হবে, যারা সঠিক জায়গায় নির্দেশমত অবস্থান করছে। যেখানে তাদের প্রয়োজন হবে সঠিকভাবে নিজের আকৃতি ধারন করে থাকা। তাইতো তারা একত্রে হয়ে নির্দিস্ট  দিকে একটি বহনকারী হয়ে গতি সৃষ্টি করছে। এই কোষগুলোর যদি একটি অংশ তাদের কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন না করে বা অন্য কোন দিকে যেয়ে কাজ করে, তাহলে ডিম্বকোষটি তার নির্দিস্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে পারবে না এবং  জন্ম সম্ভব হবে না। কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি নিখুঁত এবং প্রতিটি কোষ নির্ভুলভাবে তার কাজ সম্পন্ন করে। এভাবে ডিম্বকোষটি তার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত স্থান অর্থাৎ মায়ের গর্ভে উপনীত হয়। কিন্তু এত সতর্কতার সাথে বহন করা ডিম্বকোষটির আয়ু মাত্র ২৪ ঘন্টা। এই সময়ের মধ্যে গর্ভাধান না হলে, এর মৃত্যু ঘটবে। গর্ভাধানের জন্য এর প্রয়োজন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু; আর তা হলো- পুরুষের দেহে নিঃসৃত শুক্রাণু।

You may also like 

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়

অশ্বগন্ধা ব্যবহারের উপকারিতা

কিসমিসের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম

শুক্রাণুর গঠনঃ

যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন হয়েছে তার মধ্যে শুক্রাণুর গঠন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুক্রাণু একটি কোষ যার কাজ হচ্ছে নারীদেহের ডিম্বাণুকে পুরুষের জেনেটিক উপাত্ত প্রদান করা।ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখলে বোঝা যায়, শুক্রাণুর চেহারা এ কাজের উপযোগি করে বিশেষভাবে নির্মিত কোন যন্ত্রের মত। শুক্রাণুর সামনের অংশ বর্মসজ্জিত। প্রথম বর্মের ভিতরে আরেকস্তর বর্ম রয়েছে, এবং এই দ্বিতীয় স্তরের নিচে রয়েছে শুক্রাণু কর্তৃক বহন করা মালপত্র। এই মালপত্র হচ্ছ পুরুষের ২৩ টি ক্রোমোজম। এই ক্রোমোজোমগুলোর ভিতরে মানবদেহ সম্পর্কে খুঁটিনাটি সমস্ত তথ্য রয়েছে। নতুন একটি মানুষের জন্মের জন্য শুক্রাণুর এই ২৩ টি ক্রোমোজমের সাথে মায়ের দেহের ডিম্বাণুর ২৩ টি ক্রোমোজোম একত্রিত হওয়া দরকার। এভাবে এক ব্যক্তির ৪৬ টি ক্রোমোজোমের ভিত্তি স্থাপিত হয়।শুক্রাণুর বর্ম তার যাত্রাপথে তাকে সমস্ত বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে যাতে এই মূল্যবান মালপত্র যথাস্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু শুক্রাণুর গঠন কেবল এটুকুই নয়। এর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটি ইঞ্জিন, যার শেষাংশ শুক্রাণুর লেজের সাথে যুক্ত। ইঞ্জিনের শক্তি লেজটিকে প্রপেলারের মত ঘোরায়, যাতে শুক্রাণু দ্রুত চলাচল করতে পারে। যেহুতু মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্জিন রয়েছে, চলতে হলে এর জ্বালানীরও প্রয়োজন। এই  প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে ইঞ্জিনের সবচেয়ে কার্যকর জ্বালানী “ফ্রুকটোজ” রাখা হয়েছে শুক্রাণুকে ঘিরে থাকা তরলের মধ্যে। এভাবে সারা যাত্রাপথের জ্বালানী সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই নিঁখুত গঠনের কারণে শুক্রাণু দ্রুত ছুটে চলে ডিম্বাণুর দিকে। শুক্রাণুর দৈর্ঘ্য এবং এর যাত্রাপথের দূরত্ব হিসেব করে দেখা যায় যে, এটি একটি স্পিডবোটের মত গতিতে চলে। এই বিস্ময়কর ইঞ্জিনের উৎপাদন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঘটে থাকে। টেস্টিকলের ভেতরে যেখানে শুক্র উৎপাদিত হয়, রয়েছে প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা আণুবীক্ষণিক নল। কোন আধুনিক কারখানায় যেভাবে কনভেয়র-বেল্ট এসেম্বলী সিস্টেম কাজ করে, সেভাবেই এই নলের ভিতরে শুক্র উৎপাদিত হয়। শুক্রাণুর বর্ম, ইঞ্জিন এবং লেজের অংশ একের পর এক জোড়া লাগানো হয়। ফলশ্রুতিতে যা পাওয়া যায় তা ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিস্ময়। এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমাদের একটু চিন্তা করা উচিৎ। কিভাবে এই অচেতন কোষগুলো সঠিক আকৃতিতে শুক্রাণু তৈরি করতে পারে মায়ের দেহ সম্পর্কে কিছুই না জেনে ? কিভাবে তারা বর্ম, ইঞ্জিন এবং লেজ তৈরি করা শিখল যা মায়ের দেহে শুক্রাণুর জন্য প্রয়োজনীয় ? কোন বুদ্ধিবলে সঠিক পরস্পরায় তারা এগুলোকে ( বর্ম, ইঞ্জিন এবং লেজ) জোড়া লাগায় ? কিভাবে তারা জানে যে শুক্রাণুর জন্য ‘ফ্রুকটোজ’ দরকার হবে ? কিভাবে তারা ফ্রুকটোজ চালিত ইঞ্জিন বানানো শিখল ? এ সমস্ত প্রশ্নের একটিই উত্তর আছে আর তা হলোঃ “শুক্রাণু এবং যে তরলের মধ্যে তা স্থাপিত তা বিশেষভাবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য। শুক্রাণুর গঠনের এই আশ্চর্য পরিকল্পনা নিজেই সৃষ্টির একটি বিস্ময়। বস্তুতঃ আল্লাহ কুরআনে শুক্র ধারনকারী এই তরল সম্পর্কে বিশেষভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।  

নিষেক ক্রিয়া

নিষেক ক্রিয়া মানব সৃষ্টির রহস্য এর একটি  বিস্ময়কর ঘটনা। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন শুক্রাণু একই সময়ে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে। এত বিশাল সংখ্যার কারণ হলো গর্ভে প্রবেশের পরই এরা মারাত্নক বিপদের সম্মুখীন হয়। মাতৃগর্ভে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াকে ধবংসের জন্য ঘন এসিডের দ্রবণ থাকে। এই এসিড শুক্রাণুর জন্যও ক্ষতিকর। শুক্রাণু প্রবেশের কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাতৃগর্ভের পৃষ্ঠদেশ মৃত শুক্রাণু দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই প্রায় সমস্ত শুক্রাণুই মারা যায়। এই এসিড মাতার শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা এতটাই শক্তিশালি যে, মাতৃগর্ভে প্রবেশ করা সমস্ত শুক্রাণুকে মেরে ফেলতে পারে। সুতরাং নিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত নাও হতে পারে। এবং মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ, যিনি শুক্রাণুও সৃষ্টি করেছেন তিনি এই বিপদসংকুল পরিস্থিতির বিরুদ্বে সতর্কতার পথও দেখিয়েছেন। মানব শরীরে যখন শুক্রাণু উৎপন্ন হয় তখন তার সাথে মিশে যায় এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান । ফলে এই রাসায়নিক উপাদান মাতৃগর্ভের এসিডের প্রভাব আংশিকভাবে প্রশমিত করে দেয় এই রাসায়নিক উপাদান।  যার ফলেই কিছু শুক্রাণু মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে ডিম্বনালীতে প্রবেশ করতে  সমর্থ হয়। যদিও সব শুক্রাণুই একই দিকে যায় কিন্তু তারা কিভাবে জানলো ডিম্বাণুর অবস্থান কোথায় ? একটা ধূলিকণার চেয়েও অনেক অনেক ছোট একটি ডিম্বাণুর অবস্থান বের করা কি সম্ভব ?

শুক্রাণু ডিম্বাণুর দিকে সঠিক রাস্তায়ই যায়। কেননা এর পেছনে রয়েছে আরেকটি জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার অবদান। 

যখন শুক্রাণু ডিম্বাণু হতে প্রায় ১৫ সে:মি: দূরে থাকে তখন ডিম্বাণু এক ধরনের রাসায়নিক সংকেত পাঠায়, প্রকৃত পক্ষে এই সংকেতের মাধ্যমে ডিম্বাণু শুক্রাণুকে নিজের দিকে আমন্ত্রণ জানায়। যদিও পর্বে  কখনো তারা পরস্পরের মধ্যে  সংস্পর্শে মিলিত হয়নি। এভাবে দুইটি  অচেনা কোষ পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করে মিলিত হয়। তাই আমরা বলতে পারি শুক্রাণু এবং  ডিম্বাণুকে   কেবলমাত্র পরস্পরের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top