ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল: ইতিহাস, সংঘাত ও শান্তির খোঁজে একটি দীর্ঘ পথচলা

 “ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল: ইতিহাস, সংঘাত ও শান্তির খোঁজে একটি দীর্ঘ পথচলা” এই আর্টিকেল যখন লিখছি তখন ইসরাইলের নৃশংস হামলায় গাজায় হাজার হাজার মুসলিম ভাই বোনদের হত্যা করা হয়। লক্ষাধিক মুসলিম বাস্তুহারা, আহত হয়ে চিকিৎসার  অভাবে মারা যাচ্ছে।  বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হলো ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংঘাত। ধর্ম, জাতিসত্তা, ভূখণ্ড এবং পরাজনীতির গভীর মিশেলে গড়ে উঠা এই সংকট শত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও এর সমাধান অধরা। ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছে এই দ্বন্দ্ব, ভেঙে পড়েছে শত শত পরিবার, হাজার হাজার প্রাণ হারিয়েছে। এই প্রবন্ধে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল ইতিহাস, সংঘাতের সূচনা, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করব।


১. প্রাচীন ইতিহাস: ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের শিকড় :

এই ভূখণ্ড, যা প্রাচীনকালে ক্যানান, জুদিয়া, সামারিয়া নামে পরিচিত ছিল, হাজার হাজার বছর ধরে নানা জাতি ও সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। ইহুদিরা দাবি করে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে রাজা ডেভিড ও সলোমনের অধীনে জেরুজালেমে একটি শক্তিশালী ইহুদি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। তবে এই অঞ্চল পরবর্তীতে রোমান, বাইজানটাইন, আরব, উমাইয়া, অটোমান প্রভৃতি বহু শক্তির শাসনে যায়।

মুসলিম আরবদের আগমন ঘটে সপ্তম শতাব্দীতে, যা থেকে ফিলিস্তিনি আরব পরিচয়ের সূচনা। মুসলিমদের চোখে জেরুজালেম একটি পবিত্র নগরী, কারণ এখানে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ।


২. ব্রিটিশ শাসন ও বেলফোর ঘোষণা :

১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার “ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি” স্থাপনের সমর্থন জানায়। তখন ফিলিস্তিন ছিল মূলত মুসলিম ও খ্রিস্টান আরব অধ্যুষিত। ইহুদিদের অভিবাসন বাড়তে থাকায় আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

১৯২০-১৯৪৮ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনে এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আরব বিদ্রোহ, ইহুদি প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।


৩. ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (১৯৪৮) :

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি বিভাজন পরিকল্পনা দেয়, যাতে ফিলিস্তিনকে একটি ইহুদি ও একটি আরব রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব ছিল। ইহুদিরা এটি গ্রহণ করলেও, আরব রাষ্ট্রগুলো প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলে আরব দেশগুলো (মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ইরাক) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইসরায়েল বিজয়ী হয় এবং পূর্বের প্রস্তাবিত অঞ্চল ছাড়াও অতিরিক্ত জমি দখল করে।

এই যুদ্ধে প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়, যাদেরকে “নাকবা” বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে স্মরণ করা হয়।


৪. পশ্চিম তীর, গাজা ও পরবর্তী যুদ্ধগুলো:

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে, ইসরায়েল পশ্চিম তীর (জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল) এবং গাজা উপত্যকা (মিশরের অধীনে ছিল) দখল করে।

এই দখলদারিত্ব এখনো চলমান, যা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। এর ফলে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দ্বন্দ্ব আরও গভীর হয়।


৫. হামাস, ফাতাহ এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন

ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে মূল দুটি পক্ষ হলো:

  • ফাতাহ: পশ্চিম তীর শাসন করে, তুলনামূলকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আগ্রহী।
  • হামাস: ২০০৬ সালে গাজায় নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং বর্তমানে গাজা নিয়ন্ত্রণ করে। হামাসকে ইসরায়েল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।

এই বিভাজন ফিলিস্তিনিদের ঐক্যকে দুর্বল করে দেয়।


৬. বসতি নির্মাণ ও দখলদারিত্ব :

ইসরায়েল পশ্চিম তীরে শত শত অবৈধ বসতি তৈরি করেছে। এসব বসতিতে শুধু ইহুদি নাগরিকদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্যের উদাহরণ।

এই বসতিগুলো শান্তির পথে বড় বাধা, কারণ এগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত ভূমিতে নির্মিত হচ্ছে।


৭. গাজা সংকট ও পুনঃপুন যুদ্ধ :

২০০৮, ২০১۲, ২০১৪, এবং ২০২১ সালে গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় শত শত মানুষ নিহত হয়—যার মধ্যে বহু নারী ও শিশু থাকে।

অন্যদিকে হামাসও ইসরায়েলে রকেট ছুড়ে, যেগুলোর বেশিরভাগ ইসরায়েলের আয়রন ডোম সিস্টেম দ্বারা রুখে দেওয়া হয়।

এই সংঘাতে বেসামরিক জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


৮. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও জাতিসংঘের ভূমিকা:

জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য UNRWA প্রতিষ্ঠা করে এবং বহু প্রস্তাবে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও বসতি নির্মাণ বন্ধের আহ্বান জানায়।

তবে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে অনেকবার ভেটো দেয়, ফলে কার্যকর সমাধান সম্ভব হয়নি।


৯. ২০২৪-২০২৫ সালের বর্তমান অবস্থা:

২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। ইসরায়েল গাজায় পূর্ণমাত্রায় হামলা চালায়, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়।

২০২৪-২৫ সালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়লেও যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়নি। অনবরত বোমা হামলার ফলে মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে—খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাবে গাজা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।


১০. শান্তির পথ: সম্ভাব্য সমাধান:

বিভিন্ন শান্তি পরিকল্পনা (যেমন অসলো চুক্তি, রোডম্যাপ টু পিস) অতীতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে কিছু মৌলিক ভিত্তির ওপর সমাধান সম্ভব হতে পারে:

  1. দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান – ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সহাবস্থান করবে।
  2. বসতি নির্মাণ বন্ধ – আন্তর্জাতিক চাপে ইসরায়েল বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
  3. জেরুজালেমের যৌথ প্রশাসন – উভয় জাতি পবিত্র শহর হিসেবে অংশীদারিত্বে পরিচালনা করবে।
  4. আন্তর্জাতিক নজরদারি ও সহায়তা – শান্তিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ বা নিরপেক্ষ শক্তি তত্ত্বাবধান করবে।ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দ্বন্দ্ব শুধু একটি ভূখণ্ডের লড়াই নয়—এটি মানুষ, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও অধিকার রক্ষার লড়াই। ইতিহাসের শিকড় থেকে শুরু করে বর্তমানের সংকটময় বাস্তবতা প্রমাণ করে, একটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বও বটে।

এই সংঘাত বন্ধ হলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা পৃথিবী উপকৃত হবে। তাই আন্তর্জাতিক সমাজকে আরও সক্রিয় ও ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে হবে। শান্তি হোক স্থায়ী, মানুষের জয় হোক রক্তের ওপর!


 

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top