রাসুল (সা.) নিয়মিত সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। সোমবার ও মঙ্গলবার রোজা রাখার ফজিলত ও উপকারিতা জেনে নিন ইসলামিক আলোকে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি ইবাদতের পেছনে রয়েছে অগণিত ফজিলত ও হিকমত। ফরজ রোজা যেমন ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম, তেমনি নফল বা সুন্নত রোজা-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এসব রোজা যেমন বান্দার জন্য অতিরিক্ত সওয়াবের দরজা খুলে দেয়, তেমনি আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো—প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিয়মিত যেসব দিন রোজা রাখতেন, তার মধ্যে ছিল সপ্তাহের দুটি নির্দিষ্ট দিন: সোমবার ও বৃহস্পতিবার। এই রোজা রাখার বিষয়ে তিনি স্বয়ং উৎসাহ দিয়েছেন এবং এর পেছনে দারুণ কিছু হিকমত ও উপকারিতার কথা বলেছেন।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানবো –
👉 কেন রাসুল (সা.) সোম ও বৃহঃ রোজা রাখতেন,
👉 কী কী হাদীসে এই রোজার ফজিলত এসেছে,
👉 আর এই রোজা আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য– দুদিকেই কীভাবে কল্যাণ বয়ে আনে
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার হাদীসসমূহ
নফল রোজার মধ্যে সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোজা রাখা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে এই রোজা নিয়মিত পালন করতেন এবং উম্মতকেও উৎসাহিত করেছেন। তিনি শুধু এই আমলের নির্দেশ দেননি, বরং এর পেছনের হিকমত ও ফজিলত সম্পর্কেও পরিষ্কার ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন।
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীস
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“সোমবার ও বৃহস্পতিবারে আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। তাই আমি চাই, যখন আমার আমল পেশ হবে তখন আমি রোজাদার থাকি।”
📚 (সুনানে তিরমিজি, হাদীস: ৭৪৭)
এই হাদীসের মাধ্যমে বোঝা যায়, সপ্তাহের এই দুইদিন আল্লাহর কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়, এবং এই বিশেষ মুহূর্তে রোজাদার অবস্থায় থাকা একান্ত পছন্দনীয়।
রাসুল (সা.) নিজে কেন এই রোজা রাখতেন?
প্রিয় নবী (সা.) শুধুমাত্র উম্মতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই এই রোজা রাখেননি, বরং এই রোজার মাধ্যমে তিনি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্যচর্চা এবং আমলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।
রোজা একজন মুমিনকে:
* অশ্লীলতা, গীবত ও অহংকার থেকে বিরত রাখে
* দুনিয়াবি আসক্তি থেকে দূরে রাখে
* আল্লাহর স্মরণে হৃদয়কে কোমল ও শুদ্ধ করে
রাসুল (সা.)-এর এই সুন্নাহর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, নিয়মিত নফল রোজা রাখা কেবল সওয়াব অর্জনের পথই নয়, বরং আত্মার প্রশিক্ষণ ও আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর অন্যতম চাবিকাঠি।
সোমবার ও বৃহস্পিবার রোজার ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত
আল্লাহর কাছে আমল পেশের দিন
সপ্তাহের মধ্যে সোমবার ও বৃহস্পতিবার এমন দুটি দিন, যেদিন বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। এই বিষয়ে একাধিক সহীহ হাদীসে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“সোম ও বৃহঃ দিনে আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, যখন আমার আমল পেশ হবে, তখন আমি রোজাদার থাকি।”
📚 (সাহিহ মুসলিম: ১১৫৬, তিরমিজি: ৭৪৭)
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কাছে আমল পেশের সেই সময় রোজাদার থাকা একটি বিশেষ ফজিলতের কাজ। কারণ, রোজা অবস্থায় একজন মুমিন থাকে আত্মনিয়ন্ত্রণে, গুনাহ থেকে দূরে, এবং সে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে— যেটা আমলের মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে।
আল্লাহ বলেন:
“আমি আমার বান্দার ধারণার ওপর থাকি…”
📚 (সহীহ বুখারি: ৭৪০৫)
এই ধারণা অনুযায়ী, রোজাদার যখন বিশ্বাস করে যে তার আমল পেশ হচ্ছে এবং সে রোজার মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখছে, তখন সে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে।
অতএব, সপ্তাহের এই দুটি দিনে রোজা রাখা শুধু একটি অতিরিক্ত ইবাদত নয়, বরং এটি এমন একটি ইবাদত যা আল্লাহর দরবারে পেশকৃত আমলের মান উন্নত করে এবং বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করে।
গুনাহ মোচনের সুযোগ
রোজা এমন একটি ইবাদত, যা বান্দার গুনাহ মোচনের বড় একটি মাধ্যম। ফরজ রোজা তো বটেই, নফল বা সুন্নত রোজার মাধ্যমেও আল্লাহ তায়ালা বান্দার ছোটখাটো গুনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসুল (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন রোজা রাখে, আল্লাহ তা’আলা তার মুখমণ্ডলকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখেন।”
📚 (সহীহ বুখারী: ২৮৪০, সহীহ মুসলিম: ১১৫৩)
এই হাদীস থেকে বুঝা যায়, একটি নফল রোজাও আল্লাহর রহমতে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারে।
এছাড়া, কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই সৎকর্মগুলো মন্দ কাজগুলো মুছে দেয়।”
📖 (সূরা হুদ: ১১৪)
রোজা একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সৎকাজ। যখন কেউ ইখলাসের সঙ্গে সোম বা বৃহঃ রোজা রাখে, তখন সে কেবল ইবাদত করে না — বরং নিজের পূর্বেকার অসাবধানতাজনিত গুনাহগুলো আল্লাহর কাছে ক্ষমার আবেদন করে।
সপ্তাহে নিয়মিত এই দুটি দিন রোজা রাখার অভ্যাস একজন মুসলিমকে আত্মবিশুদ্ধির পথ দেখায় এবং গুনাহ থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
🔹 রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন আমাদের জীবনের আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কাজ, অভ্যাস ও ইবাদত ছিল উম্মতের জন্য পথনির্দেশনা। তিনি শুধু শিক্ষা দেননি—নিজে করে দেখিয়েছেন। এর মধ্যে সপ্তাহে সোম ও বৃহঃ রোজা রাখা ছিল তাঁর নিয়মিত আমল।
আয়েশা (রা.) বলেন:
“নবী (সা.) কখনোই সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা বাদ দিতেন না।”
📚 (মুসনাদ আহমাদ: ২৬০২২)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, এটি ছিল এমন একটি প্রিয় সুন্নাহ, যা রাসুল (সা.) নিয়মিতভাবে পালন করতেন। ফলে, আমরা যখন এই রোজা রাখি, তখন আমরা কেবল নফল ইবাদত করি না, বরং একটি প্রিয় সুন্নাহর অনুসরণ করি, যা আল্লাহর নিকট আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন।”
📖 (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
এ আয়াতে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণকেই আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের পথ বলা হয়েছে। তাই সোম ও বৃহঃ রোজা রাখা একদিকে যেমন ইবাদত, তেমনি এটি রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের বাস্তব রূপ।
আত্মশুদ্ধি ও ধৈর্য চর্চা
রোজা মূলত শুধু খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার নাম নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ, যার মাধ্যমে একজন মুসলিম নিজের নফস (মনের খেয়াল), কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহের ঝোঁক থেকে নিজেকে শুদ্ধ করতে শেখে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর—যাতে তোমরা পরহেযগার (আল্লাহভীরু) হতে পারো।”
📖 (সূরা বাকারা: ২:১৮৩)
এই আয়াতে রোজার মূল লক্ষ্য হিসেবে ‘তাকওয়া’ বা আত্মশুদ্ধি-কে তুলে ধরা হয়েছে। আর সোম ও বৃহঃ রোজা নিয়মিতভাবে পালন করলে ব্যক্তি নিজের ভেতরের লোভ, রাগ, অহংকার, গীবত ও কু-চিন্তা থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে মুক্ত রাখতে শেখে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা বলা ও তার উপর কাজ করা বন্ধ করলো না, আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই যে সে শুধু খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করল।”
📚 (সহীহ বুখারী: ১৯০৩)
এই হাদীস বোঝায়, রোজা রাখার মূল লক্ষ্য আত্মসংযম ও চরিত্র গঠন। সোম ও বৃহঃ রোজার নিয়মিততা একজন মুমিনকে ধৈর্যশীল, নম্র ও আত্মনিয়ন্ত্রিত মানুষে পরিণত করতে সহায়তা করে।
🔹 নিয়মিত ইবাদতের অভ্যাস তৈরি
ইসলামে ধারাবাহিক ইবাদতের গুরুত্ব অনেক। একজন মুমিনের উচিত প্রতিদিনের জীবনে এমন কিছু নফল আমল স্থায়ীভাবে চালু রাখা, যা তার ঈমানকে জাগ্রত রাখে, মনকে প্রশান্ত করে এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে। সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোজা রাখা এমনই একটি আমল, যা দ্বারা নিয়মিত ইবাদতের অভ্যাস গড়ে ওঠে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, তা-ই যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।”
📚 (সহীহ বুখারী: ৬৪৬৪, সহীহ মুসলিম: ৭৮৩)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, ধারাবাহিকতা ইবাদতে বরকত আনে। সোম ও বৃহঃ রোজা একদিকে যেমন সহজে পালনযোগ্য, তেমনি এটি একজন মুমিনকে সপ্তাহজুড়ে আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত রাখে।
এছাড়া, কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তারা এমন লোক, যারা অলসতা না করে নামাজ আদায় করে এবং নিয়মিত যাকাত দেয়…”
📖 (সূরা আনফাল: ৮:৩)
এই আয়াতে “অলসতা না করে” — এ কথার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, নিয়মিত ইবাদতকারীরাই প্রকৃত সফল। যখন কেউ সপ্তাহে নির্দিষ্ট দুটি দিনে রোজা রাখে, তখন তা তার অন্য ইবাদতের প্রতিও একটি ধাবমান মানসিকতা তৈরি করে। ধীরে ধীরে সালাত, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও অন্যান্য নফল আমলেও সে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
অতএব, সোম ও বৃহঃ রোজা রাখা কেবল এককালীন সওয়াব নয়, বরং এটি একজন মুসলিমকে ধারাবাহিকভাবে ইবাদতের পথে রাখার গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার শরয়ী বিধান
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা ইসলামে ফরজ বা ওয়াজিব নয়, বরং এটি একটি “মুস্তাহাব (প্রিয়) সুন্নত”। অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এই রোজা নিয়মিত পালন করতেন, তবে উম্মতের জন্য তা বাধ্যতামূলক করেননি।
সুন্নাতে মুয়াক্কাদা মানে এমন সুন্নত যা রাসুল (সা.) নিয়মিত করতেন এবং ত্যাগ করতেন না—এবং কেউ ত্যাগ করলে তিরস্কারের উপযুক্ত হতেন। কিন্তু সোম ও বৃহঃ রোজার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। এটি সুন্নাতে গাইরে মুয়াক্কাদা — অর্থাৎ প্রিয় সুন্নত, কিন্তু অনুস্থিতি তেমন দোষের নয়।
আয়েশা (রা.) বলেন:
“রাসুল (সা.) সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন।”
📚 (মুসনাদ আহমাদ: ২৬০২২)
🧭 ধারাবাহিকতা কিভাবে রাখা যায়?
✅ ক্যালেন্ডারে দুই দিন চিহ্নিত করে রাখো (Monday & Thursday)
✅ পরিবারের কাউকে জানাও, যেন তারা রিমাইন্ড করে
✅ প্রথমে লক্ষ্য ধরো এক মাসে অন্তত ৪টি রোজা
✅ সময়ের সাথে বাড়িয়ে নাও, ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত হবে
✅ একদিন ছুটে গেলেও আফসোস না করে আবার পরের সপ্তাহে চালিয়ে যাও
ধারাবাহিক আমলই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, যেমন হাদীসে এসেছে:
“আল্লাহর নিকট প্রিয় সেই আমল যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা সামান্য হয়।”
📚 (সহীহ বুখারী: ৬৪৬৪)
অতএব, এই রোজা রাখা আমাদের জন্য ঐচ্ছিক হলেও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, যা আত্মশুদ্ধি, সওয়াব ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ পালন—এই তিনটি কাজ একত্রে পূর্ণ করে।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
🔹 Intermittent Fasting বনাম সুন্নাহ রোজা
বর্তমান সময়ে “Intermittent Fasting” স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের মধ্যে এক অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পদ্ধতিতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় খাবার খাওয়া হয় এবং বাকি সময় উপবাসে থাকা হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই আধুনিক ডায়েট পদ্ধতির মূল ভিত্তি প্রায় হুবহু মিলে যায় ইসলামের সুন্নাহ রোজার সঙ্গে, বিশেষ করে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজার নিয়মের সঙ্গে।
Intermittent Fasting-এর মাধ্যমে যেভাবে শরীরে ইনসুলিন রেসপন্স উন্নত হয়, বিপাকক্রিয়া ঠিক হয়, অতিরিক্ত ওজন কমে — সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখলেও প্রায় একই স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয় আত্মিক প্রশান্তি ও ইবাদতের সওয়াব।
ডাক্তারগণ বলেন, নিয়মিত উপবাস:
শরীরে সেল রিপেয়ার প্রক্রিয়া সক্রিয় করে
ইনফ্ল্যামেশন কমায়
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
আর মুসলমান হিসেবে আমরা শুধু শারীরিক উপকারিতার জন্য রোজা রাখি না—
আমরা রাখি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আর তার ফলস্বরূপ আমরা পেয়ে যাই জীবনঘনিষ্ঠ উপকারও।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত রোজা রাখার মাধ্যমে একজন মুমিন শুধু আত্মিকভাবে নয়, বরং শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকেন — যার প্রমাণ আজকের আধুনিক বিজ্ঞানও দিয়েছে।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা শরীরের জন্য উপকারী
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা কেবল আত্মিক প্রশান্তি বা সওয়াবের জন্য নয়—এটি শরীরের জন্যও গভীর উপকার বয়ে আনে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বারবার প্রমাণ করেছে যে, সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকদিন উপবাসে থাকা শরীরের উপর অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১. হজম প্রক্রিয়ায় বিশ্রাম:
প্রতিদিন আমরা বারবার খাই, যার ফলে পাচনতন্ত্র কখনো বিশ্রাম পায় না।
সপ্তাহে দুই দিন রোজা রাখলে হজমতন্ত্র কিছুটা সময় বিশ্রাম পায় এবং
সেটা শরীরের মেটাবলিজমকে উন্নত করে।
২. ফ্যাট ও ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে:
নিয়মিত রোজা রাখলে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত ফ্যাট ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।
যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এই রোজা হতে পারে একটি প্রাকৃতিক উপায়।
৩. শরীর ডিটক্সিফাই হয়:
রোজা অবস্থায় শরীর নিজে নিজেই জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়।
এটি কিডনি ও লিভারের জন্যও উপকারী।
৪. ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়ায়:
রোজা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের গবেষণাতেও এই তথ্য প্রমাণিত হয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন:
“রোজা রাখো, সুস্থ থাকবে।”
📚 (সুনানে ইবন মাজাহ: ১৭৪৫)
অতএব, সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত রোজা রাখা মানে শুধু সুন্নাহ পালন নয়,
বরং নিজের শরীরকে সুস্থ, শক্তিশালী ও সচল রাখার একটি চমৎকার স্বাস্থ্য-নিয়ম।
মানসিক চাপ হ্রাস ও একাগ্রতা বৃদ্ধি
আজকের দুনিয়ায় মানুষ যেমন প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে, তেমনি বেড়েছে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশা ও মনঃসংযোগের অভাব। অনেকেই এ সমস্যার সমাধানে মেডিটেশন, থেরাপি, মেডিসিন ইত্যাদি গ্রহণ করে। অথচ ইসলাম আমাদের দিয়েছে রোজা নামক এক অলৌকিক প্রশিক্ষণ, যা একাধারে মানসিক চাপ হ্রাস করে ও ফোকাস বাড়ায়।
Read more
রোজা রাখলে মুমিন ব্যক্তি খাবার-পানীয় ছাড়াও চোখ, জিহ্বা ও মনের নিয়ন্ত্রণ শেখে।
এই আত্মনিয়ন্ত্রণই তাকে ভিতর থেকে স্থির, ধৈর্যশীল ও সংযমী করে তোলে।
বিশেষ করে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের নফল রোজা, যা ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে সাপ্তাহিক মানসিক প্রশান্তির বিরতি এনে দেয়।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে:
“রোজা রাখলে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন হ্রাস পায় এবং ব্রেইনে নিউরনের কার্যকারিতা বাড়ে, ফলে মনঃসংযোগ ও মানসিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।”
আল্লাহ বলেন :
“সাবধান! হৃদয়ের প্রশান্তি তো আল্লাহর জিকিরেই রয়েছে।”
📖 (সূরা রা’দ: ১৩:২৮)
রোজা অবস্থায় একজন মুমিন থাকে আল্লাহর স্মরণে, দোয়া ও কোরআন পাঠে —
যা তাকে আত্মিক প্রশান্তি ও মানসিক ভারসাম্য দেয়।
অতএব, সপ্তাহে নিয়মিত দুই দিন রোজা রাখলে শুধু শরীর নয়, মনের উপরও এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পড়ে, যা জীবনে ফোকাস, প্রোডাকটিভিটি এবং অন্তরের স্থিরতা ফিরিয়ে আনে।
রোজার সময়সূচি
সাহরির সময় (সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত)
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা হোক বা রমজানের, সাহরি খাওয়ার শেষ সময় নির্ধারিত হয় সুবহে সাদিক দ্বারা।
সুবহে সাদিক হলো সেই মুহূর্ত, যখন আকাশের পূর্ব দিক থেকে আলো সাদা রেখার মতো অনুভূত হয় — এটি আলোর প্রকৃত উদয়, যেখান থেকে শুরু হয় ফজরের ওয়াক্ত।
📌 সুবহে সাদিক শুরু হলে রোজার সময় শুরু হয়, এবং সাহরি গ্রহণের সময় শেষ হয়ে যায়।
📌 তাই কেউ যদি সুবহে সাদিকের পরেও খাওয়া-দাওয়া চালিয়ে যায়, তাহলে তার রোজা সহীহ হবে না।
🔸 রাসুল (সা.) বলেন:
> “তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে।”
📚 (সহীহ বুখারী: ১৯২৩)
✅ সাহরির জন্য সময় বুঝতে বিশ্বস্ত সময়সূচি অনুসরণ করা জরুরি, যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ক্যালেন্ডার বা অ্যাপ-ভিত্তিক সময়সূচি।
রোজার নিয়ত কিভাবে করতে হবে?
রোজার জন্য নিয়ত (মনস্থির করা) হলো আবশ্যক, কিন্তু তা মুখে বলাই বাধ্যতামূলক নয়।
আন্তরিকভাবে মনে মনে সংকল্প করাই নিয়ত।
তবে কেউ চাইলে মুখেও বলতে পারে, এতে কোনো দোষ নেই—বরং স্পষ্টতা আসে।
✅ নফল রোজার নিয়ত (যেমন: সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা):
রাতেই নিয়ত করাই উত্তম।
কিন্তু কেউ যদি সুবহে সাদিকের আগে খায় না এবং সকাল পর্যন্ত রোজার নিয়ত করে, তাহলেও রোজা সহীহ হবে, ইনশাআল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি সহীহ হাদীসে আছে:
“আমি আজ রোজা রাখছি,” — তিনি সকালবেলায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
📚 (সহীহ মুসলিম: ১১৫৪)
🔹 এই হাদীস প্রমাণ করে, নফল রোজার নিয়ত সুবহে সাদিকের পরে হলেও চলবে, যদি কিছু খাওয়া বা পান না করে থাকে।
🧠 নিয়তের সহজ বাংলা উচ্চারণ (যদি কেউ মুখে বলতে চায়):
“আমি সোমবার/বৃহস্পতিবার নফল রোজা রাখার নিয়ত করেছি — একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”
⚠️ ফরজ রোজার ক্ষেত্রে (যেমন রমজান):
রাতেই নিয়ত করতে হবে
সুবহে সাদিকের আগে না করলে ফরজ রোজা সহীহ হবে না
(📚 সূত্র: সুনানে আবু দাউদ: ২৪৫৪)
সারকথা:
সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা রাখার জন্য হৃদয়ের সংকল্পই নিয়ত —
মুখে না বললেও চলবে, তবে আগে খাওয়া না হলে সকালেও নিয়ত করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা বাস্তব উদাহরণ
সাহাবা (রা.)-দের জীবনী থেকে একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বাস্তব ঘটনা,
যা সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার প্রতি ভালোবাসা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইখলাসকে অনুপ্রাণিত করে।
🔹 আবু হুরাইরা (রা.)-এর নিয়মিত রোজার অভ্যাস
আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন অন্যতম বড় হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী। তিনি শুধু ইলম অর্জনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু তার আত্মশুদ্ধি ও রুহানিয়াতের চর্চা শুধু পড়ালেখায় সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি ছিলেন সপ্তাহে নিয়মিত রোজা পালনকারী একজন উদাহরণীয় মুমিন।
হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, আবু হুরাইরা (রা.) সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত রোজা রাখতেন। তিনি বলতেন:
“এই দুই দিনে আমল আল্লাহর দরবারে তুলে ধরা হয়, তাই আমি চাই আমার আমল উপবাস অবস্থায় পেশ হোক।”
📚 (মুসলিম: ১১৬২ – হাদীসের মূলভাব)
এই কথার মাধ্যমে বোঝা যায়, সাহাবাগণ শুধু জ্ঞান অর্জনেই ব্যস্ত ছিলেন না, বরং নিজের আমল ও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার দিকেও ছিলেন সচেতন।
🎯 অনুপ্রেরণা আমাদের জন্য কী?
আজকের দিনে আমরা অনেক সময় অজুহাত দেই—
# কাজের চাপ
# সময় নেই
# ক্লান্তি
তবে সাহাবারা আমাদের দেখিয়ে গেছেন, আল্লাহর জন্য ইচ্ছা থাকলে সবকিছু সম্ভব।
সপ্তাহে দুই দিন রোজা—বাহ্যিকভাবে ছোট মনে হলেও, এটা অন্তরকে বিশুদ্ধ করে, নিয়ন্ত্রণ শেখায় এবং রাসুলের (সা.) পথে চলার চর্চা গড়ে তোলে।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা কোনো কঠিন ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সহজ, নিয়মিত অভ্যাস— যা আমাদের আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর নৈকট্য ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর অনুকরণ করার সুযোগ এনে দেয়।
এই রোজা যেমন
☑️ আমাদের আমল আল্লাহর কাছে উপবাস অবস্থায় পৌঁছায়
☑️ শরীর-মনকে বিশ্রাম ও ভারসাম্য দেয়
☑️ তেমনি ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও তাকওয়ার চর্চা গড়ে তোলে।
আজকের ব্যস্ত জীবনে, যেখানে আমরা আত্মিক প্রশান্তি হারিয়ে ফেলছি—
সেখানে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন এই নফল রোজা
আমাদের ভেতরে নতুন আলো, নতুন জাগরণ আনতে পারে ইনশাআল্লাহ।
📢 চলুন, আজ থেকেই নিয়ত করি —
সপ্তাহে একদিন, তারপর ধীরে ধীরে দুই দিন…
নিয়মিত এই রোজা রাখার চেষ্টা করি —
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, নিজের আত্মার উন্নতির জন্য।
“আল্লাহর পথে এক কদম আগালেই, তিনি দশ কদম এগিয়ে আসেন।”
📚 (সহীহ বুখারী – মূলভাব)
আরো পড়ুন-